২০০৪ সালে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পাঠ্য হিসেবে পুরোটাই ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের যোগাযোগ (communication) পড়ানো হচ্ছে। শ্রেণী কক্ষে একজন শিক্ষার্থী প্রতিবাদ জানায় । সে বলে, বাংলার মানুষের যোগাযোগ পাঠ ছাড়া শুধু ইউরোপ আমেরিকার মানুষের যোগাযোগ পাঠ পড়ানো যাবে না। যে দেশের মানুষ আমি, যে সমাজের মানুষ, আমি যে মানুষ, আমাদের যোগাযোগ পাঠ ছাড়া কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী গ্রহন করব। এটা চলতে পারে না। আপন মানুষের যোগাযোগ পাঠ পড়াতে হবে। তখন আমরা লক্ষ্য করলাম, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এবং বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দশকের পর দশক ধরে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা পড়ানো হলে এর জন্য পাঠ্য তৈরি করা হয় নি। কেউ বাংলার মানুষের যোগাযোগ পড়ায় না। অতএব সমমনা শিক্ষার্থীদের নিয়ে শুরু হলো বাংলার মানুষের যোগাযোগ পাঠ উদ্ধার।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুসন্ধানী দলটির সবাই প্রায় একাডেমিক পাঠ শেষ করে রাজধানী ঢাকায় চলে আসে। বিভিন্ন জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে কাজ শুরু করে। তারা লক্ষ্য করে যে রাজধানীর নাগরিকদের মধ্যে বাংলার আদি যোগাযোগের নিজস্বতা অনেকটা বিলুপ্ত হয়েছে। একটি কৃত্রিম যোগাযোগ বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে কিছুটা প্রান্তিক মানুষ নগর থেকে দূরে বা ক্ষমতা কেন্দ্র থেকে প্রান্তিক তাদের মধ্যে বাংলার মানুষের আদি যোগাযোগ ধরনটি অনুসন্ধান করে তার শক্তি ও পাঠ উপযোগি করে তুলবে। সেই লক্ষ্যে এই দলটিই ২০১২ সালে ঢাকাতে গড়ে তোলে প্রান্তজনীয় যোগাযোগ গবেষণা কেন্দ্র (প্রাযোগ) পাঠ চক্র । কাজ শুরু করতে গিয়ে তারা লক্ষ্য করে রাজধানীতে বসে প্রান্তজনীয় যোগাযোগ অনুসন্ধান টেবিলে তৈরি এনজিও গবেষণা হবে, আসল কাজ হবে না। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয় প্রান্তের মানুষের সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করবে। মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে তারা একটি পেশা বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যেহেতু বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রান্তিক মানুষের পেশা ’কৃষি’। দলটির অধিকাংশ গ্রামের কৃষক পরিবার থেকে এসেছিল। তারা কৃষি সমাজের সাথে মিশে কাজের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা তখন আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয় এর পদ্ধতি ও কৌশল নির্ধারণ করে যে তারা প্রাণ ও প্রকৃতির ক্ষতি না করে কৃষি কাজ করবে। তারা ততদিনে বুঝে ফেলেছে বাংলাদেশের কৃষকদের রাসায়নিক সার, কীটনাশক, কৃত্রিম চাষাবাসের ফলে প্রাণ প্রকৃতি- প্রতিবেশ ও খাদ্যে বিষের কথা । ফলে তারা প্রাণ প্রকৃতি -প্রতিবেশ বান্ধব কৃষি কাজের সিদ্ধান্ত নেয়, গ্রামের কৃষক এই চাষ পদ্ধতিটির নাম দেয় ’প্রাকৃতিক কৃষি’।
২০১২ সালে গ্রামে গ্রামে কৃষি কাজের জন্য জমি খুঁজতে শুরু করে। ২০১৩ সালে মার্চ মাসে ঢাকার পার্শবর্তী জেলা মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার আমতলী গ্রামে একটি ছোট নদীর পাড়ে জমি লিজ নিয়ে রাসায়নিক সার ও বিষ ছাড়া প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কৃষি কাজ শুরু করে। সাপ্তাহিক ছুটিতে মানিকগঞ্জে গিয়ে ক্ষেতে কাজ করতে থাকে। জমিতে শাক সবজি উৎপাদন শুরু হলে আগস্ট মাসে নদী ভাঙ্গন শুরু হয়, খামারটি নদী গর্ভে চলে যায় । মূলত যুব দলটির বেতনের টাকা, বিভিন্ন খরচা থেকে বাঁচিয়ে খামারটি ব্যয় বহন করে চলেছিল। পরে ২০১৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরে কালীগঞ্জের একটি স্বেচ্ছাসেবক সংস্থার জমিতে খামার গড়ে তোলে। প্রাকৃতিক কৃষি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে সংস্থাটির জমি ও পার্শবর্তী গ্রামগুলোর কৃষক-কৃষাণীদের সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয় কালীগঞ্জে প্রাকৃতিক কৃষি কাজ করবে। তরুণরা কৃষকদের সাথে কাজ করতে ঐ গ্রামে চলে যায় । তারা সেখানে গিয়ে পুরো জমি প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ফসলের আবাদ ও গ্রামের কৃষক কৃষাণীদের সাথে যোগাযোগ শুরু করে ।
গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সাথে কথা বলে আমরা বুঝলাম, কৃষকদের রাসায়নিক সার ও বিষমুক্ত ফসলের ন্যায্যমূল্য না দিতে পারলে প্রাকৃতিক কৃষি সম্প্রসারণ করা সম্ভব না। কৃষক-কৃষাণীদের সাথে পরামর্শ করে পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকায় প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্র চালু করে বিপণন শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে বাড়ির আঙ্গিনায় কৃষাণীদের উৎপাদিত রাসায়নিক সার ও বিষ মুক্ত ফসল বিপণন শুরু হয়। ২৪ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে ঢাকায় প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্র চালু হয়। এ দিন সকালে প্রায় ২০০ কেজি সবজির প্রথম চালান কেন্দ্রে এসে পৌঁছে । বর্তমানে সেটি তিনগুনের বেশি ফসল প্রতি সপ্তাহে শুক্রবারে ৩/২৯ সালিমুল্লাহ রোড, মোহাম্মদপুর,বিপণন কেন্দ্রে বিক্রি হচ্ছে। প্রথম দিকে সপ্তাহে ১ দিন খোলা থাকলেও এখন সেটি প্রতিদিন সকাল ৯ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
রাসায়নিক সার ও বিষ মুক্ত ফসল উৎপাদন ও সম্প্রসারণে সবচেয়ে বড় বাধা এর বিপণন । গত কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন জেলার কয়েক হাজার কৃষকদের কাছ থেকে এমন সমস্যার কথা আমাদের শুনতে হয়েছে । স্থানীয় বাজারে কম মূল্য, কৃত্রিম ( রাসায়নিক সার ও বিষ দিয়ে উৎপাদিত ফসল ) ফসলের বাজার দখল , এসব ক্রমে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদনকারী কৃষকদের কোনঠাসা করে রেখেছে। তাই প্রাকৃতিক কৃষি খামারে ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি এর বিপণন ব্যবস্থার পরিবর্তনে কাজ শুরু করে । ২৪ অক্টোবর ২০১৪ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকায় প্রাকৃতিক কৃষি ফসল বিপণন শুরু হয়েছিল। পরীক্ষামূলকভাবে চলে ২০১৫ সালের মাচ মাস পর্যন্ত । এর পরে সেটি স্থায়ীভাবে পরিচালনার জন্য ঢাকার লালমাটিয়ায় এক রুমের একটি কেন্দ্র খোলা হয়। একটি স্বচ্ছ ও ন্যায়সঙ্গত বিপণন ব্যবস্থার অধীনে কৃষকের উৎপাদিত ফসলের লাভজনক মূল্য নিশ্চিত করার মধ্যদিয়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে উৎসাহিতকরণ ও সম্প্রসারিত করা এই বিপণনের উদ্দেশ্য । যৌথভাবে উৎপাদিত বিপণন ব্যবস্থা। সমাজের ভিতর থেকে পূন:রায় বিপণন সম্পর্কিত জ্ঞান অনুসন্ধান ও সেটি কাজে লাগানো। সেটিও যৌথ কাজ প্রাকৃতিক কৃষির জন্য প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্র। প্রথমে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের আগমুন্দিয়া প্রাকৃতিক কৃষি খামার ও আরও ৩টি গ্রাম থেকে রাসায়নিক সার ও কৃত্রিম বালাইনাশকের ব্যবহার ছাড়া উৎপাদিত সবজি ও ফল বিপণন কেন্দ্রে সরবরাহ শুরু হয়। বতমানে পাহাড়ী জুমসহ ১৫ টি জেলার চাষীদের উৎপাদিত ফসল বিপণন কেন্দ্রের মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে ।
মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের কাউটিয়া গ্রামে প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্র ও প্রাণ বৈচিত্র্য খামার রয়েছে। খামারটি কৃত্রিম রাসায়নিক সার , বিষ ও হরমোন মুক্ত, প্রাকৃতিক কৃষি গবেষণা, কৃষক- কৃষাণী শিক্ষণ, উৎপাদন ও বীজ সুরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। খামারটিতে দ্বিতলা বাঁশের মাচং ঘর ও বন্যা সহনশীল বাড়ি নির্মাণ মডেল দেখানো হয়েছে। প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্র সম্পূণ সৌর বিদ্যুৎএ চলে থাকে । শতাধিক দেশি জাতের ফসল , পাখি, মৌমাছি পোকামাকড়ে সমৃদ্ধ খামারটি প্রাণ বৈচিত্র্য সুরক্ষায় ভূমিকা রেখে চলেছে। খামারে মৌসুম ভিত্তিক উৎপাদিত সবজি ঢাকায় প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্র বিক্রি করে থাকে।
প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্র ও প্রাণ বৈচিত্র্য খামার গ্রাম: কাউটিয়া, ইউনিয়ান : বালিয়াখোড়া উপজেলা : ঘিওর, জেলা : মানিকগঞ্জ। যোগাযোগ : ০১৭১৮০০০২১৬
প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্র ৩/২৯, সলিমুল্লাহ রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা। যোগাযোগ : ০১৭৬০১৫৫৭৫৩, ০১৭৬২৫১১৮০১ ই-মেইল : [email protected]
প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্র ও প্রাণ বৈচিত্র্য খামার
গ্রাম: কাউটিয়া, ইউনিয়ান : বালিয়াখোড়া
উপজেলা : ঘিওর, জেলা : মানিকগঞ্জ।
যোগাযোগ : ০১৭১৮০০০২১৬
প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্র
৩/২৯, সলিমুল্লাহ রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
যোগাযোগ : ০১৭৬০১৫৫৭৫৩, ০১৭৬২৫১১৮০১
ই-মেইল : [email protected]
গাঁয়ের দোকান
সাইংজুরি – রামেশ্বরপট্টি, ঘিওর , মানিকগঞ্জ